Love for Beloved Chhayani Union

Thursday, 9 June 2016

বলছিলাম ছোট বেলার কথা । পটুয়াখালী থেকে বাবা বদলী হলেন যে জায়গায় তার নাম 'যশোর'

Post Collected from GBC Fb Group


বলছিলাম ছোট বেলার কথা । পটুয়াখালী থেকে বাবা বদলী হলেন যে জায়গায় তার নাম 'যশোর' । শহরের কারবালা এলাকায় সরকারী অফিসারদের ফ্ল্যাট । তিনটা বিল্ডিং, সাথে মাঠ - পুরো কমপ্লেক্সটা বাউন্ডারী দিয়ে ঘেরা । খেলা, পিকনিক সবই হত বাউন্ডারীর ভিতর ।
যশোরে কেজি ক্লাসে ভর্তি হলাম যেখানে তার নাম 'সেক্রেট হার্ট জুনিয়র হাই স্কুল' । পুরোদস্তুর খ্রীশ্চান মিশনারী স্কুল । টিচারদের বলতাম ব্রাদার আর সিস্টার, আর সিনিয়র টিচারদের ফাদার কিংবা ম্যাম । স্কুলের কড়া নিয়মকানুন কি জিনিষ সেটা প্রথম টের পেলাম এই স্কুলে । এসেম্বলীতে হাজির হতে এক মিনিট দেরী হলে শাস্তি, ক্লাসে কথা বললে শাস্তি, বেশী দৌড়াদৌড়ি করলে শাস্তি … … … সেই রকম কড়া আর কি । আর সিস্টার-ব্রাদাররা সবসময় হাতে বেত নিয়ে ঘুরতেন । আর সেগুলো ব্যবহার করতে একটুও ভাবাভাবি করতেন না । একদিন শুনলাম টিফিনের সময় স্কুলের গেটে নতুন এক ধরণের খাবার বিক্রি হচ্ছে । খেতে নাকি অসাধারণ ! ক্লাসে আজিজুল নামে একটা ছেলে ছিল । সে একদিন ঘোষণা দিল এর চেয়ে মজার খাবার সে এই জীবনে খায় নি, আর কখনও খাবে কিনা সে ব্যাপারেও তার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর এহেন 'স্বর্গীয়' জিনিষটা যে এখনও খায় নি তার জীবনই বৃথা । ওর বক্তব্য শুনে আমার জীবন যেন কোন রকমেই বৃথা না যায়, সে ব্যপারে উঠে পড়ে লাগলাম । খোঁজ নিলাম, দাম ২ টাকা । অবশেষে একদিন টিফিন পিরিয়ডে গেটের ফাঁক দিয়ে কিনে ফেললাম সেই পরম আকাঙ্ক্ষীত 'স্বর্গীয়' খাবার । জিনিষটা খেতে ঝালঝাল আবার একটু একটু টক টকও । বাটিতে করে দেয়, চা-র চামচে করে খেতে হয় । নরম-নরম ডালের মত তবে খাওয়ার সময় কি যেন মুচমুচেও টের পাওয়া যায় ! সব মিলিয়ে আসলেই অসাধারণ ! স্বীকার করলাম একে বেহেসতের খানা বলাটা ভুল না । এর অনেক বছর পর সেই বেহেশতী খানাটার আসল নাম আবিষ্কার করেছিলাম - 'চটপটি' ! এরপর এই জীবনে কত হাজার বার চটপটি খেলাম কিন্তু স্কুলের গেটে সেই প্রথম খাওয়া 'চটপটি'র চেয়ে বেশী মজা আর কখনই লাগে নি, লাগবে বলেও আর মনে হয় না । চটপটি ছাড়া 'সেক্রেট হার্ট জুনিয়র হাই স্কুল' নিয়ে খুব বেশী স্মৃতি আর মনে পড়ে না, কারণ বোধ হয় স্কুলটা ছিল খুব বেশী কড়া টাইপের - আনন্দের কিছু করার তেমন কোন উপায় ছিল না ।
আমরা যে বিল্ডিংএ থাকতাম সে বিল্ডিং-এর দোতলায় এডিসি আংকেল থাকতেন । আংকেল-আন্টি ছিলেন অসাধারণ মানুষ তবে নি:সন্তান । তাই বোধহয় বাসায় গেলে আদরের বন্যা বইয়ে দিতেন । মজার খাবার-দাবার থেকে শুরু করে ইচ্ছামত টিভি দেখা, গল্পের বই পড়া সবকিছুরই পারমিশন ছিল ঐ বাসায় । একদিন শুনলাম আন্টির এক মামা আসবেন বেড়াতে । সেই মামা বিয়ে করেন নি, আর করবেনও না । বয়স ৫০ এর উপরে । একদিন গিয়ে দেখি শুকনো মত একজন ভদ্রলোক, চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা, মাথার চুল একদমই হালকা আর প্রায় পাকা । বারান্দায় বসে পেপার পড়ছিলেন । আমাকে দেখে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে ডাকলেন "তুমি কোন বাসার ? এদিকে আসো ।" অপরিচিত লোক, ভারী কন্ঠ । ভয়ে ভয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়ালাম ।
- "কোন ক্লাসে পড়?"
- "কেজী তে"
- "কট-কটাকটের গল্পটা জানো?"
- "না"
- "কেজীতে পড় আর কট-কটাকটের গল্প জানো না ? কেমন কথা ! শুনতে চাও ?"
- "হু"
হাতের পেপারটা সরিয়ে রেখে ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় গল্প বলা শুরু করলেন । স্পষ্ট মনে পড়ে সেই ঝিম ধরা দুপুর বেলায়ও উনি কত সহজে আমাকে কট-কটাকটের রাজ্যে এক মূহুর্তে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন । রানীর দু:খে মন খারাপ করছিলাম আবার রাজপুত্রের বীরত্বে হাততালি দিচ্ছিলাম । সেই ছিল শুরু । আমার আজ পর্যন্ত দেখা গল্প বলিয়েদের মধ্যে উনিই সেরা ! অসাধারণ নাটকীয় ভংগী, গলার কারুকাজ আর গল্পের স্টক ! প্রথম দিনের পর থেকে দিন নেই, রাত নেই উনার কাছে গিয়ে হাজির হতাম গল্প শুনতে । ডাকতাম নানা । গেলেই বলতেন আগে মাথার চুল টেনে দিতে হবে, না হয় আংগুল টেনে দিতে হবে তারপর গল্প । চুল টানা হয়ে গেলে শুরু করতেন গল্প । আমিও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম । বিয়ে থা করেন নি । কোন পিছুটান ছিল না । যতটুকু মনে পড়ে তিনি প্রায় ৩-৪ মাস ছিলেন । এই ৩-৪ মাসের কত দুপুর, কত রাত যে উনার কাছে গল্প শুনেছি তার হিসেব নেই । গম্ভীর কন্ঠের জাদুমন্ত্রে মায়াজাল ছড়িয়ে উনি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতেন রুপকথার এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে। উনার জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় আমি কখনও হয়ে যেতাম মন্ত্রীর চক্রান্তে রাজপ্রাসাদ থেকে বহিষ্কার হওয়া দু:খী রাজপুত্র, কখনও রাক্ষসের সাথে যুদ্ধরত মহাবীর রাজা, কখনও সিন্দাবাদ, কখনও বা জারের অত্যাচারের বদলা নেওয়া সাধারণ কিন্তু বুদ্ধিমান এক রাশান সৈনিক ! আমার পুরো ছোটবেলার স্মৃতিতে সেই ৩-৪ মাস এক অমূল্য সময় ছিল । এখনও মাঝে মাঝে যখন একা থাকি, সেই নানা'র কথা মনে পড়ে । ভদ্রলোক কোথায় কিভাবে শেষ জীবনটা কাটিয়ে গেছেন জানি না, তবে দোয়া করি পরম করুনাময় গল্প বলার এই যাদুকরকে তাঁর অপার করুণার ছায়াতে রাখুন ।
একদিন বাবা বললেন যশোরে নতুন একধরণের রেস্টুরেন্ট খুলেছে, সবাইকে নিয়ে খেতে যাবেন । সেখানে নাকি চীনদেশের খাবার পাওয়া যায়, নাম 'চায়নীজ রেস্টুরেন্ট' । মহা উত্তেজনায় একদিন রাতে সেজেগুজে এসপি আংকেলসহ আরও কয়েকটা ফ্যামিলী মিলে চীনদেশের খাবার খেতে গেলাম । গিয়ে প্রথম ধাক্কা - এ কেমন অন্ধকার রেস্টুরেন্ট, ভাল করে কিছু দেখা যায় না ! ওসি আংকেলের মেয়ে ছিল, বোধহয় ক্লাস ৪-৫ এ পড়ত । আমার কাছে সে তখন বিরাট বড় মানুষ । আমাকে বলল চীন দেশটা নাকি এমন অন্ধকার অন্ধকারই হয় । তাই ওদের খাবারও খেতে হয় এইরকম অল্প আলোতে । এত মুরুব্বী একজন বলেছেন, ভুল হয় কি করে ! মাথা নেড়ে মেনে নিলাম । পরবর্তী ধাক্কা ছিল যখন খাবার সার্ভ করল । সাদা সাদা পানির মত, ডিম ডিম গন্ধ, স্বাদহীন ! বিচ্ছিরী এক জিনিষ ! বাবা বলল এর নাম স্যুপ ! চীন দেশের খাবারের উপর ভক্তিশ্রদ্ধা উঠে গেল, সাথে চীন দেশের মানুষদের উপর থেকেও ! যারা এরকম অখাদ্য খায়, তাদের উপর ভক্তিশ্রদ্ধা বাকী থাকে কিভাবে ! বাবার বকার ভয়ে সেই অখাদ্য (!) স্যুপ পুরো একবাটি গলাধ:করণ করতে হলো । পরবর্তিতে স্যুপের ভয়ে অনেক বার চাইনীজ খেতে যাই নি । ব্যপারটা রীতিমত বিভীষিকার মত মনে হত !
যশোরে আমি প্রথম প্রানী পোষার সুযোগ পেলাম । রেজাল্ট ভাল করায় (অবশ্য ফার্স্ট না) বাবা একজোড়া খরগোশ এনে দিলেন । বিটিভিতে তখন প্রচারিত ছোটদের 'এসো গান শিখি' অনুষ্ঠানের বিখ্যাত দুই পাপেট 'মিঠু ও মন্টি'র নাম অনুসারে খরগোস দুটোর নাম দিলাম 'মিঠু' আর 'মন্টি' । খরগোস প্রতিদিনের রুটিনে নতুন উত্তেজনা যোগ করল । বিকেলে নিজেই মাঠ থেকে ঘাস তুলে নিয়ে আসতাম । কোলে করে খাওয়ানোর চেষ্টা চলত সারাদিনই । ছাদের নিয়ে বেড়াতাম । মিঠু-মন্টির বাচ্চা হলো - ওরা সংখ্যায় তখন দাঁড়ালো মোট চার। ছোট ফিডার কিনে আনা হলো । গরুর দুধ ভরে খাওয়ানোর চেষ্টা চলত । জুতার বক্সে তুলা দিয়ে আলাদা বিছানা বানানো হলো । ঠান্ডা লাগে না যেন । সে এক বিরাট আয়োজন !
যশোরের সময়টা পারিবারিক ভাবে আমাদের খুব দূ:চিন্তার সময় ছিল । যশোর তখন সর্বহারা, কম্যুনিস্ট পার্টি আর চোরাকারবারীদের স্বর্গরাজ্য । এএসপি হিসেবে জয়েন করার পরেই বাবা ক্রাক ডাউনে নামলেন । কয়েকমাসের মধ্যেই ওদের জন্য ত্রাসে পরিণত হলেন । যথারীতি ওরাও চুপ থাকল না । প্রথমে পলিটিক্যাল প্রেসার, তারপর উড়ো চিঠি । তাতে কাজ না হওয়ায় বাবার উপর তিন তিনবার সশস্ত্র আক্রমণ হলো । গাড়িতে বোমা মারা থেকে শুরু করে সরাসরি গুলি । আব্বুর সাথে থাকা বডি গার্ড স্পটেই মারা গেল । আরেক সাবইন্সপেকটরের হাতের কব্জী উড়ে গেল । বাবা অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন । রেন্জ ডিআইজি বাবাকে ডেকে বললেন নিজের নিরাপত্তার জন্যই তাঁকে যশোর ছাড়তে হবে, না হলে বাবাকে প্রটেক্ট করা সম্ভব হবে না ।
শেষ হয়ে এলো আমাদের যশোরের মাত্র দেড় বছরের জীবন । আবার বাসা গোছানো শুরু । আবার নতুন কোন জায়গায় নতুন করে জীবন শুরু। যাযাবরের জীবন ।
LikeShow more reactions
Comment

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comment.

 

SSC Chemistry

SSC Chemistry

 
Blogger Templates